{ads}

কংক্রিট ব্লক বা কংক্রিট ইট বলতে কি বুঝি

ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধন কংক্রিট ব্লকে ঘর বানানোর চর্চা বাড়ায় দেশে ইটভাটার কারণে পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে নতুন আশা সৃষ্টি করেছে। গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই) গত কয়েক দশক ধরে পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরির প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে প্রচলিত ইটের বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী উদ্ভাবনে গবেষণা করে চলেছে। সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে। কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে বানানো ইট পোড়াতে কয়লা ও গাছ ব্যবহার করায় পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। এইচবিআরআইয়ের গবেষণা কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ৩০ ধরনের কংক্রিট ব্লক উদ্ভাবন করা হয়েছেন। এগুলো পরিবেশবান্ধব, মূল্যসাশ্রয়ী, ওজনে হালকা, ভূমিকম্প, আগুন ও লবণাক্ততা প্রতিরোধী, অতি উষ্ণ বা অতি শীতল আবহাওয়ার বিপরীতে নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ দেয়।’ তার মতে, এগুলো দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়সাশ্রয়ী। এসব ব্লক তৈরিতে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহারের পরিবর্তে নদীর তলদেশের মোটা বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়। কখনো ফ্লাই অ্যাশ, পাথরের ধুলো বা অন্যান্য সামগ্রীও ব্যবহার করা হয়। তিনি জানান, এ ধরনের ব্লকের মধ্যে রয়েছে: কম্প্রেসড স্ট্যাবিলাইসড আর্থ ব্লক (সিএসইবি), ইন্টার লিংকিং সিএসইবি, কংক্রিট হোলো ব্লক, থার্মাল ব্লক (টিবি), ফেরো সিমেন্ট স্যান্ডউইচ প্যানেল, সেলুলার ব্লক, ফ্লাই অ্যাশ ব্রিক ও অন্যান্য। সুশাসনের জন্য নাগরিক কমিটির (সনাক) নীলফামারী জেলা শাখার সাবেক সভাপতি সফিকুল আলম ডাবলু ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব ইকো ব্লকের নানান সুবিধা ও প্রচলিত ইটভাটা থেকে সৃষ্ট পরিবেশের ক্ষতি রোধের দায়বদ্ধতা থেকে মানুষ ক্রমশ পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’ গত ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সব সরকারি নির্মাণকাজে প্রচলিত ইটের পরিবর্তে শতভাগ পরিবেশবান্ধব ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করেছে। এলজিইডির নীলফামারী জেলা কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে সব সরকারি নির্মাণ কাজে পরিবেশবান্ধব ব্লক ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। আমাদের বেশ কিছু স্থাপনা সরকারি নির্দেশনা মেনে তৈরি করা হচ্ছে।’ এইচবিআরআইয়ের রিসার্চ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন ডেইলি স্টারকে জানান, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব ব্লকের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। এর মধ্যে কনকর্ড গ্রুপ অব কোম্পানি বিশেষ করে পেভমেন্ট, দেয়াল ও ছাদের জন্য ব্লক তৈরি করছে। মীর সিরামিক মেঝে, দেয়াল, সিঁড়ির জন্য তৈরি করছে পরিবেশবান্ধব টাইলস। এ ছাড়াও, বিশাল মেঘনা গ্রুপ, এসিআই, রূপায়ন গ্রুপ, ইস্টার্ন হাউজিংসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ কাজে সম্পৃক্ত আছে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, বিল্ডিং টেকনোলজি ও আইডিয়াস লিমিটেড রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এইচবিআরআইয়ের সহযোগিতায় পরিবেশবান্ধব সামগ্রী দিয়ে বহুতল ভবন তৈরি করছে। নেদারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক কোম্পানি ইকো সলিউশান লিমিটেড নীলফামারীর সদর উপজেলার হাজীরহাট গ্রামে কারখানা স্থাপন করে ২০২০ সাল থেকে পরিবেশবান্ধব কম্প্রেসড স্ট্যাবিলাইজড আর্থ ব্লক (সিএসইবি) তৈরি করছে, যা এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ব্লক নির্মাণে ৭০ শতাংশ নদীর তলদেশ থেকে নেওয়া মোটা বালু, ১০ শতাংশ সিমেন্ট ও ২০ শতাংশ শুকনো মাটি মিশিয়ে মেশিনে উচ্চমাত্রায় চাপ দেওয়া হয়। কারখানার কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল ওয়াদুদ সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বর্তমানে প্রতি মাসে আমাদের ১ লাখ ব্লক উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা শিগগির এর উৎপাদন বাড়াচ্ছি। আমাদের পরিবেশবান্ধব ব্লক দিয়ে এলাকায় একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি হাসপাতাল ও ৬০টি ঘর তৈরি করা হয়েছে। আরও অনেকগুলো তৈরি করা হচ্ছে।’ নীলফামারী পৌরসভার সবুজপাড়া এলাকার পাভেল রহমান এই প্রতিষ্ঠানটির ব্লক ব্যবহার করে বাসা তৈরি করেছেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সিএসইবি ব্লক ব্যবহার করে সম্ভাব্য খরচের ৩০ শতাংশ সাশ্রয় হয়েছে। এ ধরনের ১ হাজার ব্লক প্রচলিত ১ হাজার ৭৫০ ইটের মতো কার্যকরী। গাঁথুনির জন্য সিমেন্ট, বালু ও পানি কম লাগে। রাজমিস্ত্রীর খরচও কম।’ ‘দেয়ালে প্লাস্টারের প্রয়োজন না হওয়ায় সরাসরি রঙ করা যায়,’ যোগ করেন তিনি। ঠাকুরগাঁওয়ের পারপুগি গ্রামে বছর কয়েক আগে বাবলু সুপার ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে পরিবেশবান্ধব ব্লক তৈরিতে ৪০ শতাংশ ফ্লাই অ্যাশ, ৪০ শতাংশ বালু, ১৫ শতাংশ সিমেন্ট ও ৫ শতাংশ পাথরকুচি ব্যবহার করা হয়। এসব ব্লক ঠাকুরগাঁওসহ আশেপাশের জেলায় বেশ বাজার পেয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। ঠাকুরগাঁও জেলা শহরের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন তার বাসা তৈরিতে ফ্লাই অ্যাশযুক্ত ব্লক ব্যবহার করেছেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ সব উপকরণে তৈরি বাড়ি বেশ আরামদায়ক। এগুলো খুব বেশি ঠাণ্ডা ও গরম প্রতিরোধ করে ঘর আরামদায়ক রাখে।’ এইচবিআরআইয়ের গবেষণা কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন জানান, তাদের উদ্ভাবিত কংক্রিট ব্লকগুলো এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশে প্রায় আড়াই হাজার ছোট-ছোট কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এইচবিআরআইয়ের প্রিন্সিপাল রিসার্চ অফিসার আহসান হাবীব ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে নির্মাণকাজে দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য আমরা প্রতিমাসে ৫০ নির্মাণ কর্মী ও অন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’ পরিবেশ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রচলিত ইটভাটার সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজারের মতো। এসব ভাটায় বছরে প্রায় ২২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন পোড়া ইট হয়। এ জন্য ২৫ বিলিয়ন কিউবিক ফুট টপ সয়েল পোড়াতে সাড়ে ৩ মিলিয়ন টন কয়লা ও ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। যা থেকে মারাত্মক ক্ষতিকর ৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন গ্রিন হাউস গ্যাস হয়। নীলফামারীর কৃষি বিভাগের উপপরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চাষযোগ্য জমির উপরিভাগের মাটি ইটভাটায় ব্যবহারের কারণে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত লাগসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি ও কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’ পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল হামিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইটভাটা থেকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হওয়ায় তা থেকে মুক্তি পেতে আমরা রোড ম্যাপ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। নির্মাণ কাজে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লকের বহুল ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।’ সুত্র : ডেইলী স্টার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.