ক্লোরিন দ্বারা জ্বীবাণুমুক্ত করা
ক্লোরিন বিভিন্ন রূপে পানির জীবানুনাশ করার জন্য বহুল ব্যবহৃত একটি কেমিকেল। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে পানিশোধণে ক্লোরিন ব্যবহার শুরুর করার পর সারা বিশ্বে পানিজনিত রোগে মৃত্যূহার অনেক হ্রাস পেয়েছে। একটি ভাল জীবানুনাশকের অনেকগুলো বৈশিষ্টই ক্লোরিনে রয়েছে তবে তা সত্ত্বেও ক্লোরিন দিয়ে জীবানুনাশে কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এটা বহুল ব্যবহৃত ও সহজলভ্য হওয়াতে এর প্রয়োগের কিছু খুটিনাটি দিক এখানে উল্লেখ করা হল।
পানিকে জীবানুমুক্ত করতে কতক্ষণ ধরে কী মাত্রার ক্লোরিন প্রয়োগ করতে হবে সেটা বেশ কয়েকটা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। অপেক্ষকৃত বেশি তাপমাত্রায় ক্লোরিন দ্রুত কাজ করে - অর্থাৎ শীতকালে সময় একটু বেশি লাগবে। এছাড়া পানির pH এর উপর ক্লোরিনের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে। এটা বুঝতে নিচের সমীকরণ দেখি:
Cl + HO → HOCl + HCl এবং এরপরে HOCl <==> H+ + OCl¯
অর্থাৎ পানিতে ক্লোরিন মেশালে সেটা হাইপোক্লোরাস এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিড উৎপন্ন করে। আবার এই হাইপোক্লোরাস এসিড বিযোজিত হয়ে হাইপোক্লোরাইট আয়ন আকারেও থাকতে পারে। কখন কোন রূপে থাকবে সেটা পানির pH এর উপর নির্ভর করে। কম pH এ সরাসরি ক্লোরিন আকারে থাকে যা জীবানুনাশে সর্বাধিক কার্যকরী। মাঝামাঝি pH এ অর্থাৎ সাধারণ পানিতে এটা হাইপোক্লোরাস এসিড আকারে থাকে – এটাও জীবানুনাশে খুবই কার্যকর; তবে উচ্চ pH তথা ক্ষারীয় পানিতে এটা হাইপোক্লোরাইট আয়ন আকারে থাকে যার জীবানুনাশী ক্ষমতা অনেক কম। পানি শোধনাগারে অনেক ক্ষেত্রেই ম্যাঙ্গানিজ এবং খরতা দুর করার জন্য চুন মেশানো হয় যা পানির pH বাড়িয়ে দেয়। ক্লোরিন প্রয়োগের আগে সেই পানির pH কমিয়ে নিতে হবে।
পানিতে জৈব যৌগ থাকলে সেটার সাথে ক্লোরিনের বিক্রিয়ায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বস্তু/যৌগ উৎপন্ন হতে পারে – যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে পানি সরবরাহের কাজে যে পরিশোধিত পানি ব্যবহার করা হয় তাতে সাধারণত জৈব যৌগ থাকে না - তাই রক্ষে। তা সত্বেও মাধ্যমিক উৎস থেকে জৈব যৌগ পানিতে মিশতে পারে, তাই উন্নত দেশে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় এই ক্ষতিকারক যৌগ আছে (তৈরী হয়েছে) কি না তা নিয়মিত মনিটর করা হয়।
পানির সরবরাহ লাইনের কোন ছিদ্র বা ফাটল দিয়ে কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে মধ্যবর্তী দূষণ ঠেকাতে সরবরাহকৃত পানিতেও কিছু মাত্রায় (০.০৫ মিলিগ্রাম/লিটার) ক্লোরিন মিশিয়ে দেয়া হয়। তবে এই
মাত্রার ক্লোরিন পানিতে রাখার জন্য কত মাত্রায় ক্লোরিন মেশাতে হবে তা ল্যাবরেটরীতে পানির নমুনাতে পরীক্ষা করে বের করতে হয়। কারণ প্রাথমিক ভাবে ক্লোরিনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্লোরিন খরচ করার মত অনেক উপাদান থাকে যা প্রযুক্ত ক্লোরিনকে খরচ করে ফেলে। এছাড়া পানিতে অ্যামিন জাতীয় যৌগ থাকলে সেগুলোও ক্লোরিন খরচে বিক্রিয়া করে, শুরুর দিকে এই যৌগে থাকা ক্লোরিন উপস্থিতি জানান দিলেও শেষ পর্যায়ে হুট করে গায়েব হয়ে যায়, ফলে দ্রবণে ক্লোরিনে মাত্রা বাড়ার পর আবার কমে যায়। তাই এই দুই পর্যায়ে ক্লোরিন খরচ পার করে তারপর পানিতে উদ্দিষ্ট মাত্রার ক্লোরিন পেতে যতটুকু প্রয়োগ দরকার সেটা নির্নয় করতে হয়। এই পদ্ধতিকে Break point chlorination বলা হয়। এভাবে প্রযুক্ত ক্লোরিনও মাঝপথে বিক্রিয়া করে শেষ হয়ে যেতে পারে, কিংবা খোলা পানিতে (রিজার্ভ ট্যাংকে) উদ্বায়ী রূপে বাতাসে মিশে যেতে পারে।
বিভিন্ন পদার্থকে ক্লোরিনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যেমন: ক্লোরিন গ্যাস, ব্লিচিং পাউডার বা ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইট Ca(OCl)Cl (৩৩% পর্যন্ত ক্লোরিন থাকে), হাই-টেস্ট হাইপোক্লোরাইট (৬০ – ৭০% ক্লোরিন), সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (১২ – ১৫% ক্লোরিন)।
এছাড়াও জরুরী অবস্থায় পানি শোধন কাজে হ্যালোট্যাব বা ক্লোরিনের ট্যাবলেট ফার্মেসিতে পাওয়া যায়। কত পরিমাণ পরিষ্কার পানিতে একটি ট্যাবলেট দিতে হবে সেটা ট্যাবলেটের ফয়েলে/মোড়কে লেখা থাকে। ২০০১ সালের দিকে ৫ টাকায় ১০টা ট্যাবলেটের এক পাতা কিনতে পাওয়া যেত, যার একটা ট্যাবলেট দিয়ে ৩ লিটার পানি জীবানুমুক্ত করা যেত। পানিতে কিছুটা ক্লোরিন তথা ব্লিচিংপাউডার টাইপের গন্ধ থাকে। গৃহস্থালীতে এভাবে পানি শোধন করে সেই পানিকে সামান্য গরম করলেই সমস্ত গন্ধ চলে যাওয়ার কথা। আমাদের দেশে মানুষ পানিতে ক্লোরিন তথা ব্লিচিং-এর গন্ধ পেলে নাক সিটকায়, অথচ উন্নত বিশ্বে বরং এই গন্ধ পেলেই পানি পান করতে নিরাপদ বোধ করে মানুষ, আর সরবরাহকৃত পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ না থাকলেই সেই পানি পান করতে ইতস্তত করে।
বলাই বাহুল্য যে, ঢাকা শহরে সরবরাহকৃত পানির একটা বড় অংশ ডিপ টিউবওয়েলের পানি, যাতে শুরুতে জীবানু থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সরবরাহ লাইনে লিক দিয়ে দূষণ হওয়া অসম্ভব নয়। অনেক এলাকাতেই পানির লাইন পয়ঃনিষ্কাশন নালার মধ্যদিয়ে গিয়েছে – যা অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। বিশেষত আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় পাইপগুলোতে সর্বদা পানির চাপ থাকে না, বরং দিনের নির্দিষ্টি কিছু ঘন্টায় পানি ছাড়া হয়। যখন এই পাইপগুলোতে পানি সরবরাহ হয় তখন চাপের কারণে বাইরের দূষণ এর ভেতরে ঢুকতে পারবে না বরং ভেতরের পানি-ই ছিদ্র বা লিক দিয়ে বের হয়ে আসবে; কিন্তু অন্য সময়ে প্রবাহের চাপ না থাকায় বাইরের দূষিত পানি পাইপে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া বাসা-বাড়ির নিচতলায় এবং ছাদে পানির ট্যাংকিগুলো পানিতে জীবানু প্রবেশের অন্যতম পথ। তাই এই ট্যাংকিগুলো এবং ব্যবহারের শুরুতে পুরা পানি সরবরাহ পাইপগুলোকে জীবানুমুক্ত করে নেয়া জরুরী। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে একটা জেরিকেনে ব্লিচিং গুলে সেখান থেকে ট্যাংকির পানিতে ফোটায় ফোটায় পড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিয়মিতভাবে দৈনিক ফ্রেস ব্লিচিং দ্রবণ দিলে জীবানুর সম্ভাবনা তো কমবেই, বরং পানি ফুটিয়ে খাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও ফুরাতে পারে।
If you have any doubt , let me know.