{ads}

ভবনের নিরাপত্তায় রেট্রোফিটিং | Retrofitting of buildings

রেট্রোফিটিং Retrofitting of  buildings

রেট্রোফিটিং হলো পুরাতন সংস্কারের প্রযুক্তি যা নতুন প্রযুক্তি ও উন্নত পদ্ধতিতে পুরাতন স্থাপনাগুলিকে পরিবর্তন করে তাদের সামর্থ্য বৃদ্ধি করে এবং তাদের সুরক্ষা, সুরক্ষা, এবং সাস্থ্য মান বাড়ানোর লক্ষ্যে। এটি ধরনভেদে সংস্কারের সুযোগ উপস্থাপন করে, যাতে পুরাতন বা অভিজ্ঞ স্থাপনার ক্ষমতা ও পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান করা যায়।


সাভার ট্র্যাজেডির পর দেশব্যাপী বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পরিচালিত হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন ভবন চিহ্নিত করার কাজ। অনেক ভবন মালিকদের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটিই যেখানে দুশ্চিন্তার কারণ ছিল, সেখানে যোগ হয়েছে তা ভাঙা। স্বাভাবিকভাবেই তাই অনেকের চিন্তা, কীভাবে ভবনটিকে না ভেঙে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ করা যায়। এ ভাবনারই সহজ সমাধান রেট্রোফিটিং। রেট্রোফিট হলো ভবনের পুনর্জন্ম। জরাজীর্ণ ভবনে নবজীবন লেপে দেওয়া, যেখানে পুরোনো ভবনটিকে না ভেঙে নতুন করা সম্ভব। প্রায় প্রতিটি ভবনেই রেট্রোফিটিং করা সম্ভব। যথাযথভাবে যদি কাজটি করা যায়, তাহলে ভবনের স্থায়িত্বও বেড়ে যাবে ৫০ বছর বা তারও বেশি।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রেট্রোফিটিং বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় ভবনসংস্কার পদ্ধতি। বিভিন্ন ডেভেলপার ও বিল্ডিং সার্ভিস কোম্পানিগুলো পুরো স্ট্রাকচার ডিজাইন করা থেকে যাবতীয় সংস্কার ও পরিচর্যামূলক কাজ পরিচালনা করে থাকে। এগুলোর ভেতর বহুতল শপিং মল, ঐতিহ্যবাহী পুরোনো স্থাপনা ও পূর্বপুরুষের স্থাপনার সংখ্যাই বেশি। ফলে যেমন রক্ষা পায় পুরোনো ঐতিহ্য, তেমনি থেকে যায় পূর্বপুরুষের স্মৃতিও। বিশ্বে রেট্রোফিটিংয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আমেরিকার অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ভবন। বাংলাদেশে রেট্রোফিটিংয়ের ধারণা বহুল প্রচলিত না হলেও একেবারে নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই কাজটি হচ্ছে এ দেশে। বাংলাদেশের কতিপয় স্থপতি ও প্রকৌশলী ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজটি করছেন। এখনো এ দেশে শুধু রেট্রোফিটিংয়ের জন্য স্বতন্ত্র কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কতিপয় পুরোনো স্থাপনা যেমন কার্জন হলের মসজিদ, আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, পাহাড়পুর, কান্তজির মন্দির ইত্যাদিতে বাংলাদেশ আর্কোলজি ডিপার্টমেন্টের সহযোগিতায় কিছু স্থাপত্য ও প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান সংস্কারকাজ করলেও একে পুরোপুরি সংস্কার না বলে আংশিক সংস্কার বলাই ভালো। কিন্তু এগুলোকে যদি ভালোভাবে সংস্কার করা যায়, তাহলে এসব স্থাপনা আরও শত শত বছর স্থায়ী হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার আর পুনঃসংস্কারের মাধ্যমে যেখানে একটা নতুন ভবন ১০০ বছর টিকতে সক্ষম, সেখানে যদি সঠিকভাবে ভবনকে রেট্রোফিটিং করা যায়, তাহলে একটি ভবনের স্থায়িত্ব হবে শতবর্ষ। ডিজাইনে দুর্বলতা থাকলে, ডিজাইনে দুর্বলতা নেই কিন্তু ভবনের ব্যবহার পরিবর্তন হলে অর্থাৎ আবাসিক ভবনকে যদি ফ্যাক্টরি বা অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় এবং ঐতিহাসিক ভবন রক্ষায়ও রেট্রোফিটিং করানো হয়। তবে পুরাকীর্তিসমূহ রেট্রোফিটিংয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, যেন কোনোভাবেই তার আদি রূপ নষ্ট না হয়। প্রথমেই এর কৌশল ঠিক করতে হবে। একজন আর্কিটেক্ট এর নকশা প্রণয়ন, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার তার কাঠামোগত দিকগুলোকে যাচাই ও নিশ্চিত এবং প্রকৌশলীরা তা বাস্তবায়ন করবেন। সংস্কার করা ভবনটি যেন সর্বোচ্চ শক্তিমাত্রা অর্জন করে নিজস্ব ভর, বায়ুচাপ, ভূমিকম্প, তাপমাত্রা ও জলবায়ুসহিষ্ণুতা অর্জন করতে সক্ষম হয়, তা খুবই গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।
বর্তমানে যেসব ভবন আরসিসি কাঠামোতে নির্মিত হচ্ছে, তার প্রতিটি অংশই গুরুত্বপূর্ণ। তার পরও প্রথমত, ভবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি। দ্বিতীয়ত, কলাম এবং তৃতীয়ত, বিম। ফাউন্ডেশন ও কলামধস বা ফাটল যেকোনো ভবনের জন্য খুবই ভয়াবহ। একটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি অংশই দায়ী। অনেক সময় একটা বিম ভাঙলে অন্যটা ভাঙে না। ভবনের কোনো বিমে ফাটল ধরলে বা ফেইল করার আগে তার ভারবহন ক্ষমতা জানান দেয়। প্রায় ১০-১৫ বছর আগে থেকেই প্লাস্টার খসে যাওয়া, কিছুটা বেঁকে যাওয়া, ফাটল ধরাসহ কতিপয় উপসর্গের মাধ্যমে এর অক্ষমতা ফুটে ওঠে। কিন্তু কলাম ও ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রে খুবই নগণ্য সময় থাকে। ফাউন্ডেশন যদি ফেইল করে তাহলে সেটা ভবনের জন্য খুবই ভয়াবহ। কলামের ক্ষেত্রেও তা-ই। মেশ, স্টিল, রিইনফোর্সড কংক্রিট, ফাইবার রিইনফোর্সড পলিমার কম্পোজিট (FRPC) ইত্যাদি ধরনের জ্যাকেটিং, ক্রস ব্রাকেটিং, ভিসকাস ডাম্পার, ক্রস সেকশন, ভিসকাস ফ্লইড ডাম্পার, টিউনড ম্যাচ ডাম্পার (TMD), স্প্রিং, স্টিল ব্রেসিং ইত্যাদির সাহায্যে কলামকে আরও মজবুত করা যায়।
বুয়েটের তদন্তে দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনের ফাটলই খুব ভয়াবহ নয়। তবে রয়েছে পুরোপুরি ঝুঁকিপূর্ণ, আংশিক ঝুঁকিপূর্ণ ও মেরামতযোগ্য ভবন। প্রাথমিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙতে বা অপসারণে ভবনের মালিককে নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এটাকেই যুক্তিসংগত মনে করলেও সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করছেন না। তাঁদের মতে, এই বিপুলসংখ্যক ভবন ভাঙার ফলে যে পরিমাণ কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি হবে, তার গতি কী হবে? মাত্র নয়তলাবিশিষ্ট একটি ভবন ভাঙতেই যেখানে প্রায় এক মাস সময় লাগল, সেখানে এই শত শত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙতে কত দিন সময় লাগবে। ভেঙে ফেলাই এর উৎকৃষ্ট সমাধান বলে মানতে তাঁরা নারাজ। বরং এগুলোকে কীভাবে রেখে এটাকে নিরাপদ করা যায়, সেটাই হতে পারে প্রকৃত সমাধান এবং রেট্রোফিটিংই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায়।
প্রতিদিনই গড়ে উঠছে নানা রকম ভবন। জমির স্বল্পতাজনিত কারণে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। একে পুঁজি করে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো পুরোনো ভবনকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলছে দৃষ্টিনন্দন সব ভবন। কিন্তু মানের প্রশ্নে রয়েছে বিতর্ক। অসংখ্য ডেভেলপার কোম্পানি এ দেশে থাকলেও একটি পুরোনো ভবনকে পুরোপুরি না ভেঙেও কীভাবে তাকে নতুন করে গড়া যায় সে বিষয়ক ধারণা ও উদ্যোগের যথেষ্ট অভাব দেখা যায়। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলেরও তেমন প্রচার-প্রচারণা নেই। রেট্রোফিটিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে যদি সঠিকভাবে এ দেশের নির্মাণশিল্পে বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো যায়, তাহলে একদিকে যেমন রক্ষা পাবে বিপুল পরিমাণের নির্মাণব্যয় ও সম্পদের অপচয়, অন্যদিকে নিশ্চিত হবে নিরাপদ বসবাস। ভবনের খুঁটিনাটি বিষয় জানা সাধারণ মানুষে পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাজউক, বুয়েট, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত সচেতনতা বাড়ানো ও ব্যাপক প্রচারণা চালানো এবং স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানামুখী পরিকল্পনা নেওয়া। রানা প্লাজা ধসের পর থেকে আমাদের দেশের ভবন মালিকেরা তাঁদের ভবনকে রেট্রোফিটিং করার জন্য এবং কাঠামো পরীক্ষা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের কাছে যাচ্ছে। বিষয়টি সচেতনতার দিক থেকে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তবে এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পরীক্ষায় শুধু কাঠামোগত ফেইলে ত্রুটির বিষয়টি দেখা হচ্ছে, কিন্তু এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য ত্রুটি যেমন নকশা প্রণয়নে ত্রুটি, অভ্যন্তরীণ লে-আউটে ত্রুটি, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশগত ত্রুটি, অগ্নি নির্গমনের নকশা প্রণয়নে ত্রুটি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহকে দেখা হচ্ছে না—যা একই সঙ্গে একান্তভাবে কাম্য ছিল এবং যা অবশ্যই পুনর্নির্মাণের অংশ। যার সব ধরনের ত্রুটি পর্যবেক্ষণের জন্য অবশ্যই একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি কমিটি প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যেসব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিষ্ঠানগুলো এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তার কোনোটাই সঠিকভাবে এই মাল্টিডিসিপ্লিনারি কমিটির কথা ভাবছে না, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের প্রকৌশলীদের সঙ্গে স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ এমনকি সমাজবিজ্ঞানীসহ কারখানা কিংবা ভবনের মান উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করবে। কারণ, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আজ যারা বিপদের মধ্য দিয়ে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের নিকট দৌড়াচ্ছে, নিজেদের সব স্বার্থ ভুলে তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে হবে। নইলে ব্যর্থতার মূল্য আমাদেরই বহন করতে হবে এবং বিশ্বাসটুকুও হারাতে হবে। আর অবহেলা নয়। যদি ভবন নির্মাণে কোনো অসংগতি থেকেও থাকে, তাহলে এখনই তার সমাধান করুন। নতুবা আপনার আবাস ভবনটিই হতে পারে নিজের, সন্তানের বা পরিবারের সবার করুণ মৃত্যুর কারণ।
(মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষা, বিশেষজ্ঞ অভিমত এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রবন্ধটি তৈরি)
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.