একটি শোক ভুলতে না-ভুলতে ঘটে আরেকটি শোকের ঘটনা। সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় গোটা দেশ শোকার্ত এখন।
সংবাদমাধ্যম থেকে যতটা জানতে পেরেছি, ওই জমিতে ছয়তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল সাভার পৌরসভা। রাজউকের কাছে না পাঠিয়ে সাভার পৌরসভা ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়ে যেমন একটি অন্যায় করেছে, তেমনি ছয়তলা ভবনের অনুমতি পেয়ে মালিক নয়তলা ভবন নির্মাণ করে আরেকটি অন্যায় করেছেন। কিন্তু যেসব প্রশ্ন এখনো তোলা হয়নি তা হলো:
১. ভবনটি নির্মাণের জন্য যে জলাশয়টি ভরাট করা হয়েছিল, তা ভরাট করা কি বৈধ ছিল? ঢাকা ও তার আশপাশসহ দেশের যেকোনো এলাকার যেকোনো জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল যে কেউ ইচ্ছা করলেই কি ভরাট করতে পারে?
২. ভবনটির নকশা কি কোনো নির্ভরযোগ্য স্থপতি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল? করা হয়ে থাকলে সেই স্থপতি কি জানতেন যে এই ভবনটি তৈরি পোশাক কারখানার কাজে ব্যবহূত হবে?
৩. ভবনটির কাঠামোর ডিজাইন নির্ভরযোগ্য কোনো কাঠামো প্রকৌশলীকে দিয়ে করানো হয়েছিল কি? করা হয়ে থাকলে তিনি কি জানতেন যে এই ভবনটি তৈরি পোশাক কারখানার কাজে ব্যবহূত হবে? সাধারণ শপিংমল আর ফ্যাক্টরির ডিজাইন এক নয়।
৪. ভবনটির নির্মাণকাজে ব্যবহূত কংক্রিট ও রডের মান নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল কি? আপাতদৃষ্টিতে রানা প্লাজা নির্মাণে ব্যবহূত কংক্রিট নিম্নমানের মনে হয়েছে। তদন্ত কমিটির উচিত হবে কংক্রিট ও রডের পরীক্ষা করে দেখা।
৫. ভবন নির্মাণে ওয়ার্কিং ড্রয়িং যদি তৈরি করা হয়ে থাকে তবে নির্মাণকাজ (ওয়ার্কম্যানশিপ) সেই ওয়ার্কিং ড্রয়িং অনুসারে করা হয়েছিল কি? ৬. ভবনটির নির্মাণ কোনো প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে হয়েছিল কি? নাকি রাজমিস্ত্রির হাতই ছিল যথেষ্ট (সাধারণত এ দেশে যা হয়ে থাকে)?
রানা প্লাজা ধসে যে স্যান্ডউইচ আকার ধারণ করেছে, তার মধ্যে ওপরের অনেক প্রশ্নের উত্তর আছে। ব্যক্তিমালিকানায় কেউ ভবন নির্মাণ করলে নির্ভরযোগ্য স্থপতি, কাঠামো প্রকৌশলী, বিদ্যুৎ প্রকৌশলী ও প্লাম্বার বিশেষজ্ঞদের পেছনে মালিকের অর্থ খরচে প্রবল অনীহা। অথচ তাঁদের পরামর্শ নিয়ে এবং সদিচ্ছার সঙ্গে কাজটি করলে অনেক ক্ষেত্রে অর্থের সাশ্রয় করা এবং এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। অনেক মালিক মনে করেন, রাজমিস্ত্রিই যথেষ্ট। এর আসল কারণ ভবন নির্মাণে কম অর্থ খরচ করতে চাওয়া। এটি ভবন-মালিকের মারাত্মক ভুল প্রবণতা, যার পরিণাম অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ হতে পারে।
রানা প্লাজা একবারে ধসে না পড়ে দুই দিন আগেই সংকেত দিয়েছিল পিলারের ফাটলের মধ্য দিয়ে। অন্তত দুর্ঘটনা এড়ানোর মতো নমনীয়তা ভবনের কাঠামো দেখিয়েছে (সারভাইভাল লিমিট)। তখন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের দিয়ে সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো এবং তাঁদের পরামর্শমতো ব্যবস্থা নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। সেই সুযোগটি নষ্ট হয়েছে কিছু লোকের বাড়াবাড়ির কারণে এবং ধৈর্যের অভাবে। একজন সুশিক্ষিত মানুষও সব জ্ঞানের মালিক হতে পারেন না। হওয়ার প্রয়োজনও নেই। একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের পক্ষেও ওপেন হার্ট সার্জারি সম্পর্কে মত দেওয়া ঠিক নয়, যদি তিনি একজন বিশেষজ্ঞ সার্জন না হন। না জানা না বোঝা বিষয়ে বিজ্ঞের মতো মতামত দেওয়া বা নাক গলানো যে ঠিক নয় তার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে এই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি।
সাভারের স্পেকট্রাম, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ফিনিক্স ভবন এবং সাভারের রানা প্লাজা—এসবই ছিল কংক্রিটের কাঠামোর ওপর তৈরি নতুন ভবন। অথচ ভবনগুলো ধসে পড়তে ভূমিকম্প হওয়ার প্রয়োজন হয়নি। এগুলোর সবই ঘটেছে ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, নির্মাণকালীন অব্যবস্থার ফলে। ভবন তার নিজের ভর এবং ভবনে রাখা জিনিসপত্রের ভর বহন করতে অক্ষমতার কারণে ধসে পড়েছে। এমন কারণে যদি একটি দেশের একটি ভবনও ধসে পড়ে, তবে তা ওই দেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করে।
বাংলাদেশের নির্মাণশিল্পে কোনো জবাবদিহি নেই, যদিও দেশে ইমারত নির্মাণের বিধিমালা ১৯৯৩ তৈরি হয়েছিল এবং ২০০৬ সালে তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঢাকা ও তার আশপাশ এলাকার ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়াসহ এর অভিভাবকত্ব করার দায়িত্ব রাজউকের। রাজউকের অনুমতি না নিয়ে যদি কেউ ভবন নির্মাণ করে, তাকে ধরার দায়িত্বও রাজউকের। রানা প্লাজা একটিমাত্র অমাবস্যার অন্ধকার রাতে নির্মিত হয়নি। নাকের ডগায় এত বড় একটি ভবন নির্মিত হলো বছরের পর বছর ধরে (নয়তলার নির্মাণকাজ চলমান ছিল) তখন রাজউক কী করেছে? রাজউক বলে থাকে, ‘লোকবলের অভাব’। হাজার হাজার কোটি টাকার প্লট, ভবন, ফ্লাইওভার ইত্যাদি নির্মাণ করার কাজ করে যে রাজউক, তার লোকবলের অভাব হয় কেন? স্পেকট্রাম, ফিনিক্স, শাঁখারীবাজার, কলাবাগানসহ আরও এমন ঘটনা থেকে রাজউক কী শিক্ষা নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়ানোর জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে? রাজউক কি কোনো ভবনের দুর্বলতার সন্ধান পেয়ে রেট্রোফিটিং করার জন্য মালিককে পরামর্শ দিয়েছে? দরজা খোলা রেখে ঘুমানোর পরিণতি নিশ্চয়ই রাজউকের অজানা নয়।
ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) একটি পুরকৌশল বিভাগ আছে। বিভাগটির উচিত হবে ভবন ধসে পড়া বা গার্ডার ধসে পড়ার মতো পুরকৌশলগত কাঠামোর দুর্ঘটনাগুলোর প্রকৌশলগত কারণ অনুসন্ধান করা। তাদের প্রাপ্ত তথ্য থেকে কী করলে দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত, সে বিষয়ে প্রকৌশলীদের মধ্যে সচেতনতার লক্ষ্যে তা একটি বিশেষ সংখ্যার নিউজ লেটারের মাধ্যমে আইইবির সদস্যদের জানিয়ে দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে একই কারণে একই দুর্ঘটনা না ঘটে। শুধু রাজউকই নয়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সদিচ্ছাই পারে এমন মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে।
স্পেকট্রাম, ফিনিক্স, র্যাংগস, রানা প্লাজা থেকে পরিলক্ষিত হয়েছে, বাংলাদেশ ধসে পড়া ভবন থেকে উদ্ধারকাজ চালাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। উদ্ধারকাজে ব্যবহার করার মতো প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রপাতি সরঞ্জামও পর্যাপ্ত নেই। ধসে পড়া একটিমাত্র ভবন সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। শুধু সরকারের ভান্ডারে নয়, সাধারণ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ভান্ডারেও উদ্ধারকাজের জন্য যন্ত্রপাতি ও টুলস থাকা দরকার। তাই দেশের নেতৃস্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব মেশিন নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে শুল্কমুক্ত আমদানি করার সুযোগ দিলে ভালো হয়। উন্নত অনেক দেশে রিকন্ডিশন্ড মেশিনের বড় বড় নিলাম হয়, যেখান থেকে এ দেশের নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে এসব মেশিন কিনতে পারবে। এসব মেশিনের পরিচয় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোয় লিপিবদ্ধ থাকবে। সরকার কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় যখনই এ মেশিনগুলো প্রয়োজন মনে করবে, তখনই ওই কোম্পানিগুলো তা সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে।
ভবন নির্মাণ বিধিমালা মানা হচ্ছে কি না, তা শুধু ওয়ার্কিং ড্রয়িং দেখে নয়, নির্মাণস্থল পরিদর্শন ছাড়া জানা সম্ভব নয়। নির্মাণস্থলও রাজউকের বিশেষজ্ঞ টিম দ্বারা ঝটিকা সফর করে নিয়ন্ত্রণ হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে রাজউক উপযুক্ত পরামর্শক নিয়োগ করতে পারে। অভিভাবক রাজউক কর্তৃক ভবন নির্মাণকাজ নিয়ন্ত্রণই যদি না হয় তবে অদূরদর্শী ভবন-মালিকদের ভবন ধসে সাধারণ মানুষ মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারাবে, যা কারও কাম্য নয়।
ড. মো. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব।
সংবাদমাধ্যম থেকে যতটা জানতে পেরেছি, ওই জমিতে ছয়তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল সাভার পৌরসভা। রাজউকের কাছে না পাঠিয়ে সাভার পৌরসভা ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়ে যেমন একটি অন্যায় করেছে, তেমনি ছয়তলা ভবনের অনুমতি পেয়ে মালিক নয়তলা ভবন নির্মাণ করে আরেকটি অন্যায় করেছেন। কিন্তু যেসব প্রশ্ন এখনো তোলা হয়নি তা হলো:
১. ভবনটি নির্মাণের জন্য যে জলাশয়টি ভরাট করা হয়েছিল, তা ভরাট করা কি বৈধ ছিল? ঢাকা ও তার আশপাশসহ দেশের যেকোনো এলাকার যেকোনো জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল যে কেউ ইচ্ছা করলেই কি ভরাট করতে পারে?
২. ভবনটির নকশা কি কোনো নির্ভরযোগ্য স্থপতি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল? করা হয়ে থাকলে সেই স্থপতি কি জানতেন যে এই ভবনটি তৈরি পোশাক কারখানার কাজে ব্যবহূত হবে?
৩. ভবনটির কাঠামোর ডিজাইন নির্ভরযোগ্য কোনো কাঠামো প্রকৌশলীকে দিয়ে করানো হয়েছিল কি? করা হয়ে থাকলে তিনি কি জানতেন যে এই ভবনটি তৈরি পোশাক কারখানার কাজে ব্যবহূত হবে? সাধারণ শপিংমল আর ফ্যাক্টরির ডিজাইন এক নয়।
৪. ভবনটির নির্মাণকাজে ব্যবহূত কংক্রিট ও রডের মান নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল কি? আপাতদৃষ্টিতে রানা প্লাজা নির্মাণে ব্যবহূত কংক্রিট নিম্নমানের মনে হয়েছে। তদন্ত কমিটির উচিত হবে কংক্রিট ও রডের পরীক্ষা করে দেখা।
৫. ভবন নির্মাণে ওয়ার্কিং ড্রয়িং যদি তৈরি করা হয়ে থাকে তবে নির্মাণকাজ (ওয়ার্কম্যানশিপ) সেই ওয়ার্কিং ড্রয়িং অনুসারে করা হয়েছিল কি? ৬. ভবনটির নির্মাণ কোনো প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে হয়েছিল কি? নাকি রাজমিস্ত্রির হাতই ছিল যথেষ্ট (সাধারণত এ দেশে যা হয়ে থাকে)?
রানা প্লাজা ধসে যে স্যান্ডউইচ আকার ধারণ করেছে, তার মধ্যে ওপরের অনেক প্রশ্নের উত্তর আছে। ব্যক্তিমালিকানায় কেউ ভবন নির্মাণ করলে নির্ভরযোগ্য স্থপতি, কাঠামো প্রকৌশলী, বিদ্যুৎ প্রকৌশলী ও প্লাম্বার বিশেষজ্ঞদের পেছনে মালিকের অর্থ খরচে প্রবল অনীহা। অথচ তাঁদের পরামর্শ নিয়ে এবং সদিচ্ছার সঙ্গে কাজটি করলে অনেক ক্ষেত্রে অর্থের সাশ্রয় করা এবং এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। অনেক মালিক মনে করেন, রাজমিস্ত্রিই যথেষ্ট। এর আসল কারণ ভবন নির্মাণে কম অর্থ খরচ করতে চাওয়া। এটি ভবন-মালিকের মারাত্মক ভুল প্রবণতা, যার পরিণাম অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ হতে পারে।
রানা প্লাজা একবারে ধসে না পড়ে দুই দিন আগেই সংকেত দিয়েছিল পিলারের ফাটলের মধ্য দিয়ে। অন্তত দুর্ঘটনা এড়ানোর মতো নমনীয়তা ভবনের কাঠামো দেখিয়েছে (সারভাইভাল লিমিট)। তখন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের দিয়ে সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো এবং তাঁদের পরামর্শমতো ব্যবস্থা নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। সেই সুযোগটি নষ্ট হয়েছে কিছু লোকের বাড়াবাড়ির কারণে এবং ধৈর্যের অভাবে। একজন সুশিক্ষিত মানুষও সব জ্ঞানের মালিক হতে পারেন না। হওয়ার প্রয়োজনও নেই। একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের পক্ষেও ওপেন হার্ট সার্জারি সম্পর্কে মত দেওয়া ঠিক নয়, যদি তিনি একজন বিশেষজ্ঞ সার্জন না হন। না জানা না বোঝা বিষয়ে বিজ্ঞের মতো মতামত দেওয়া বা নাক গলানো যে ঠিক নয় তার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে এই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি।
সাভারের স্পেকট্রাম, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ফিনিক্স ভবন এবং সাভারের রানা প্লাজা—এসবই ছিল কংক্রিটের কাঠামোর ওপর তৈরি নতুন ভবন। অথচ ভবনগুলো ধসে পড়তে ভূমিকম্প হওয়ার প্রয়োজন হয়নি। এগুলোর সবই ঘটেছে ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, নির্মাণকালীন অব্যবস্থার ফলে। ভবন তার নিজের ভর এবং ভবনে রাখা জিনিসপত্রের ভর বহন করতে অক্ষমতার কারণে ধসে পড়েছে। এমন কারণে যদি একটি দেশের একটি ভবনও ধসে পড়ে, তবে তা ওই দেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করে।
বাংলাদেশের নির্মাণশিল্পে কোনো জবাবদিহি নেই, যদিও দেশে ইমারত নির্মাণের বিধিমালা ১৯৯৩ তৈরি হয়েছিল এবং ২০০৬ সালে তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঢাকা ও তার আশপাশ এলাকার ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়াসহ এর অভিভাবকত্ব করার দায়িত্ব রাজউকের। রাজউকের অনুমতি না নিয়ে যদি কেউ ভবন নির্মাণ করে, তাকে ধরার দায়িত্বও রাজউকের। রানা প্লাজা একটিমাত্র অমাবস্যার অন্ধকার রাতে নির্মিত হয়নি। নাকের ডগায় এত বড় একটি ভবন নির্মিত হলো বছরের পর বছর ধরে (নয়তলার নির্মাণকাজ চলমান ছিল) তখন রাজউক কী করেছে? রাজউক বলে থাকে, ‘লোকবলের অভাব’। হাজার হাজার কোটি টাকার প্লট, ভবন, ফ্লাইওভার ইত্যাদি নির্মাণ করার কাজ করে যে রাজউক, তার লোকবলের অভাব হয় কেন? স্পেকট্রাম, ফিনিক্স, শাঁখারীবাজার, কলাবাগানসহ আরও এমন ঘটনা থেকে রাজউক কী শিক্ষা নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়ানোর জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে? রাজউক কি কোনো ভবনের দুর্বলতার সন্ধান পেয়ে রেট্রোফিটিং করার জন্য মালিককে পরামর্শ দিয়েছে? দরজা খোলা রেখে ঘুমানোর পরিণতি নিশ্চয়ই রাজউকের অজানা নয়।
ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) একটি পুরকৌশল বিভাগ আছে। বিভাগটির উচিত হবে ভবন ধসে পড়া বা গার্ডার ধসে পড়ার মতো পুরকৌশলগত কাঠামোর দুর্ঘটনাগুলোর প্রকৌশলগত কারণ অনুসন্ধান করা। তাদের প্রাপ্ত তথ্য থেকে কী করলে দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত, সে বিষয়ে প্রকৌশলীদের মধ্যে সচেতনতার লক্ষ্যে তা একটি বিশেষ সংখ্যার নিউজ লেটারের মাধ্যমে আইইবির সদস্যদের জানিয়ে দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে একই কারণে একই দুর্ঘটনা না ঘটে। শুধু রাজউকই নয়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সদিচ্ছাই পারে এমন মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে।
স্পেকট্রাম, ফিনিক্স, র্যাংগস, রানা প্লাজা থেকে পরিলক্ষিত হয়েছে, বাংলাদেশ ধসে পড়া ভবন থেকে উদ্ধারকাজ চালাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। উদ্ধারকাজে ব্যবহার করার মতো প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রপাতি সরঞ্জামও পর্যাপ্ত নেই। ধসে পড়া একটিমাত্র ভবন সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। শুধু সরকারের ভান্ডারে নয়, সাধারণ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ভান্ডারেও উদ্ধারকাজের জন্য যন্ত্রপাতি ও টুলস থাকা দরকার। তাই দেশের নেতৃস্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব মেশিন নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে শুল্কমুক্ত আমদানি করার সুযোগ দিলে ভালো হয়। উন্নত অনেক দেশে রিকন্ডিশন্ড মেশিনের বড় বড় নিলাম হয়, যেখান থেকে এ দেশের নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে এসব মেশিন কিনতে পারবে। এসব মেশিনের পরিচয় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোয় লিপিবদ্ধ থাকবে। সরকার কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় যখনই এ মেশিনগুলো প্রয়োজন মনে করবে, তখনই ওই কোম্পানিগুলো তা সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে।
ভবন নির্মাণ বিধিমালা মানা হচ্ছে কি না, তা শুধু ওয়ার্কিং ড্রয়িং দেখে নয়, নির্মাণস্থল পরিদর্শন ছাড়া জানা সম্ভব নয়। নির্মাণস্থলও রাজউকের বিশেষজ্ঞ টিম দ্বারা ঝটিকা সফর করে নিয়ন্ত্রণ হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে রাজউক উপযুক্ত পরামর্শক নিয়োগ করতে পারে। অভিভাবক রাজউক কর্তৃক ভবন নির্মাণকাজ নিয়ন্ত্রণই যদি না হয় তবে অদূরদর্শী ভবন-মালিকদের ভবন ধসে সাধারণ মানুষ মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারাবে, যা কারও কাম্য নয়।
ড. মো. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব।
If you have any doubt , let me know.